ইউক্রেন যুদ্ধ আরও তীব্র হতে যাচ্ছে

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ইউক্রেনে তাঁর সশস্ত্র বাহিনীকে ৩৬ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি পালনের নির্দেশ দেন। ৭ জানুয়ারি রুশ অর্থোডক্স ক্রিসমাস উপলক্ষে এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে, যা রাশিয়া ও ইউক্রেনে পালিত হয়। অনেকেই এ ঘোষণাকে দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ বন্ধের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন; তবে বিষয়টি আদৌ তা নয়।

ইউক্রেনে হামলার ১১ মাসের মধ্যে এই প্রথম রাশিয়া পুরোপুরি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এই সাময়িক বিরতি আপাতদৃষ্টিতে শর্তহীন মনে হচ্ছে। তবে মস্কো বন্ধ রাখতে চাইলেও ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে চাইছে। এর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার কথা বলেছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার একতরফা যুদ্ধবিরতিতে কতটা শান্তি আসবে? কিয়েভ ও মস্কো উভয়েই এখন তাদের লক্ষ্য পূরণে অবিচল এবং এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। তাদের বিশ্বাস, আগামী দিনে যুদ্ধের ময়দানে তারা আরও ভালো অবস্থানে থাকবে।

ভদ্মাদিমির পুতিন দাবি করছেন, রাশিয়া যে অঞ্চল দখল করেছে, সেটা ইউক্রেন ছেড়ে দিক এবং কিয়েভ রাশিয়ার দখলের স্বীকৃতি দিক। অন্যদিকে কিয়েভ দাবি করছে, রাশিয়া ইউক্রেনের সব ভূমি ফিরিয়ে দিক। ক্রেমলিনের বক্তব্য- 'ভদ্মাদিমির পুতিন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে রাশিয়ার খোলাখুলি অবস্থান তুলে ধরেছেন। কিয়েভের উচিত ব্যাপক পরিচিত ও বারবার উচ্চারিত রুশ শর্তগুলো পূরণ করা এবং নতুন ভূমি-সংক্রান্ত বিষয় বিবেচনায় নেওয়া।' তবে যেহেতু গত সেপ্টেম্বর থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী যুদ্ধে বেশ সাফল্য পাচ্ছে; ইউক্রেনের রাশিয়ার দাবি পূরণের কোনো কারণ নেই। এ সময়ে বরং ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ফলে তারা এই মোমেন্টাম হারাতে চাইবে না। কিংবা তারা এমন কিছু করতে চাইবে না, যাতে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তা হ্রাস করে। অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহের জন্য চাপ দিচ্ছেন, যাতে ইউক্রেন আবার পাল্টা আক্রমণ শুরু করতে পারে।

এর আগে ২০২২ সালে, যখন রাশিয়ার সাঁজোয়া যান কিয়েভের কাছাকাছি অবস্থান নেয়, ইউক্রেন তখন তুরস্কের মধ্যস্থতার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী ছিল এবং তাদের ভূমি-সংক্রান্ত আপস করতেও যেন তারা প্রস্তুত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইউক্রেনের সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থান অধিক শক্তিশালী। ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সন্দেহ করছে, যুদ্ধবিরতি শুধু মস্কোকে পুনরায় সুসংগঠিত ও পরবর্তী হামলার জন্য আরও প্রস্তুত করবে। উভয়ের সম্মতিতে একটি উন্মুক্ত যুদ্ধবিরতি হতে পারে, কিন্তু সে সময়টি এখনও আসেনি।


রাশিয়া গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন ১ লাখ ৯০ হাজার সেনা নিয়ে আক্রমণ করে, তখনই কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং ইউক্রেন সরকারের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সে সূচনার হিসাব যখন উল্টাপাল্টা হয়ে যায়, এর পর ক্রেমলিন আর বেশি সুবিধা করতে পারেনি। ভদ্মাদিমির পুতিন ছয় মাসের জন্য এ 'বিশেষ সামরিক অপারেশন' চালানোর কথা বলেছিলেন। তেমনটা হলে রাশিয়ার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে যুদ্ধের প্রভাব খুব কমই হতো।

দেশটির পূর্বদিকে খারকিভ ঘিরে ইউক্রেনীয়দের পাল্টা আক্রমণ সফলতা পায় এবং সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রাশিয়া খেরসন তথা ইউক্রেনের দক্ষিণ থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। অথচ সেখানে রাশিয়া তিন লাখ অতিরিক্ত সেনা মজুত রেখেছিল। কিন্তু রাশিয়ার যুদ্ধ-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের মতো সেনা সমাবেশ সুশৃঙ্খলভাবে হয়নি এবং সামরিক ভারসাম্যের জন্য সেখানে যথেষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষিত সেনা ছিল না। ইউক্রেনে রাশিয়ার সফলতা এটা যে, তারা ইউক্রেনীয় অবকাঠামো ধ্বংস করতে পেরেছে এবং বিশেষ করে লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিক্ষেপ করা মিসাইল ও ড্রোনের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক গ্রিডে হামলা করে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারত, যদিও এখন সে সম্ভাবনা সীমিত।

ইউক্রেন থেকে দূরে রাশিয়া যে সফলতা পেয়েছে, তা হলো অর্থনৈতিক ক্ষতি। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে এটা বেশি হয়েছে। আমরা দেখেছি, তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপের অন্যরা ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট অতিক্রম করছে। তবে এ যুদ্ধে বিদ্যমান শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে পারে। ধরা যাক, রাশিয়ার বাহিনীর বড় ধরনের পরাজয় ঘটল। তখন ক্রেমলিন তার সম্মুখ যোদ্ধাদের নিয়ে আরও অধিক যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহ প্রকাশ করল; কিন্তু এই যুদ্ধবিরতি দিয়ে শান্তি আনা সহজ নয়। বর্তমানে ইউক্রেন যেখানে এগিয়ে আছে, সেখানে তাদের পেছনে ফেরার অবস্থা নেই। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যখন চিন্তা করছেন যে তাঁরা জয়লাভ করছেন, তখন ইউক্রেনীয় মানুষকে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি বোঝাতে কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। যুদ্ধবিরতি তখনই সম্ভব হবে, যখন ইউক্রেনীয় বাহিনী মনে করবে, তারা ব্যাপকভাবে হেরে যাচ্ছে। সম্ভবত তখনও কিয়েভ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবে বলে মনে হয় না।

মস্কো হয়তো হিসাব করছে, ইউক্রেন যদি কোনোভাবে অবস্থান পাল্টাতে সম্মত না হয়, তখন তাদের সহায়তা প্রদানকারী পশ্চিমা গোষ্ঠী কিয়েভের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে যুদ্ধ শেষ করতে তারা আলোচনায় আসে এবং প্রয়োজনীয় শর্ত মেনে নেয়। তবে এটা তখনই হতে পারে, যখন পশ্চিমা শক্তি এই চিন্তা করবে যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ও রাশিয়া এমন একটি চুক্তিতে আসবে, যেখানে মস্কো তাদের হার মেনে নেবে। কিন্তু এমনটা ঘটার কোনো আলামত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

একটা যুদ্ধে যে কোনো ফলই হতে পারে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে যুদ্ধ আরও তীব্রতা পাবে। সাময়িক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি এখনই আসছে না।

প্যাট্রিক ককবার্ন: সাংবাদিক; 'ওয়ার ইন দ্য এজ অব ট্রাম্প'-এর লেখক; কাউন্টারপাঞ্চ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

মন্তব্য করুন

Logo

© 2023 Dinkal24 All Rights Reserved.