ঋণে সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার চাপ বাড়ছে

উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রভাবে কমেছে সঞ্চয় প্রবণতা। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়ছে ঋণের চাপ। এর মধ্যে গত বছর ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উঠে এসেছে। এসব কারণে তারল্যের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সংকটে থাকা এক ব্যাংক এখন আরেক ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও প্রতিনিয়ত বড় অঙ্কের ধার দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বিদ্যমান ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা প্রত্যাহারের ওপর চাপ বাড়ছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকগুলো অনেক দিন ধরেই সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কেননা ঋণে ৯ শতাংশ সুদের সীমা থাকায় আমানতে সুদ বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আবার সুদ না বাড়িয়েও ঋণ পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত সুদহার বাজারভিত্তিক করা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও সুদহারের সীমা প্রত্যাহার অথবা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

গত জুলাইয়ে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির একটি প্রতিনিধি দল গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে সুদহারের সীমা প্রত্যাহার চেয়ে চিঠি দেয়। সেখানে বলা হয়, চলমান মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে ঋণের সুদহারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। বড় ঋণ বাদে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বিলাসবহুল পণ্য উৎপাদন ও আমদানি, অনুৎপাদনশীল ও আমদানিনির্ভর শিল্প ঋণ এবং ভোক্তা ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা প্রত্যাহার চাওয়া হয়। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর অনুরোধ করা হয়। তবে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জানান, সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করলে খরচ বেড়ে যাবে। আপাতত তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছর আগেও ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে কমে গত অক্টোবরে তা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকায় নেমেছে। এর মধ্যে অক্টোবরের তুলনায় গত নভেম্বর মাসে মেয়াদি আমানত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা কমে ১৩ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমেছে।

মূলত বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তির ফলে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখেন। যে কারণে আমানত কমেছে। আর সামগ্রিক তারল্যের ওপর চাপ বাড়ার অন্যতম কারণ বেসরকারি খাতে ১৪ শতাংশের মতো ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১ হাজার ২৬১ কোটি ডলার বিক্রির বিপরীতে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।

ব্যাংকাররা জানান, বাজারে তারল্য বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে সিএমএসএমই খাতের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল করা হয়েছে। আবার রপ্তানি খাতের উন্নয়নে ১০ হাজার কোটি টাকা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ৫ হাজার কোটি টাকাসহ কম সুদের বিভিন্ন তহবিল গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নামমাত্র সুদে এ অর্থ দেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকার নতুন করে যে ঋণ নিচ্ছে তার প্রায় সবই সরবরাহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে আগে দেওয়া ঋণের মেয়াদপূর্তি হলেও তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিশোধ করছে। ব্যাংকিং পরিভাষায় এ ধরনের প্রক্রিয়াকে ডিভল্ক্বমেন্ট বা নিজের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে বোঝায়। পরে ব্যাংক খাতে তারল্য বাড়লে এসব বিল বন্ড আবার অফলোড বা বাজারে ছাড়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিভল্ক্বমেন্ট বাড়ার ফলে চলতি অর্থবছরের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। অথচ এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৪৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে ১৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা কমেছে।

বাজারে তারল্য বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগের মধ্যেও আন্তঃব্যাংক কলমানির সুদহার বাড়ছে। গতকাল কলমানিতে এক দিন মেয়াদি ধারের গড় সুদহার ওঠে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। কয়েক মাস আগেও যা আড়াই শতাংশের মতো ছিল।

আন্তঃব্যাংকে স্বল্পমেয়াদি অন্য সব লেনদেনের সুদহার উঠেছে ৮ শতাংশের ওপরে। আবার সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার অনেক বেড়েছে। ১ জানুয়ারি ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ওঠে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারিতে যা ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ।

মন্তব্য করুন

Logo

© 2023 Dinkal24 All Rights Reserved.