নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ০১:১০ এএম
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরলেন সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও টাঙ্গাইলের ৩১৫ চরমপন্থি। রবিবার (২১ মে) দুপুরে সিরাজগঞ্জ র্যাব-১২ সদর দফতরে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) লাল পতাকা ও সর্বহারাসহ বেশ কয়েকটি চরমপন্থি দলের ৩১৫ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন।
চরমপন্থি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে র্যাব মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন তার বক্তব্যের শুরুতেই তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার নেতৃত্বে দীর্ঘ ০৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। সেই সাথে স্মরণ করেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ৩০ লক্ষ বীর শহীদদের ও সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের। এছাড়া তিনি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে আরও স্মরণ করেন সে সকল দেশপ্রেমী, অকুতোভয় র্যাব সদস্যদের যারা দুঃসাহসিক অভিযাত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শান্তির ভিত রচনায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে অমর হয়ে রয়েছেন। তিনি তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন।
র্যাব মহাপরিচালক তার বক্তব্যে বলেন, র্যাবের অভিযানে সুন্দরবন আজ জলদস্যুমুক্ত। র্যাব আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যু এবং তাদের পরিবারকে বিভিন্ন ধরণের মানবিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যুরা যাতে তাদের পুরনো পেশায় ফিরে না যায় সে জন্য র্যাব তাদেরকে সমাজে স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন ধরণের পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। যার ফলে সুন্দরবনে এখন শান্তির সু-বাতাস বইছে। এছাড়াও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য র্যাবের ডি-র্যাডিকালাইজেশন ও রি-হ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গিকে মনস্তাত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুরদর্শী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে “সন্ত্রাসী পেশা ছাড়ি, আলোকিত জীবন গড়ি” এই স্লে গানকে সামনে রেখে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে এবং চরমপন্থিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। সরকারের এ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে দুই হাজারের বেশি চরমপন্থি অস্ত্র সমর্পণ করে। অস্ত্র সমর্পণের পর তাদের মধ্যে ৭০০ জন’কে আনসার বাহিনীতে চাকুরি দেওয়া হয়। বর্তমান সরকারের সঠিক দিক নির্দেশনায় র্যাব সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চরমপন্থিদের দৌঁরাত্ম নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের প্রথম দিকে র্যাব-১২, সিরাজগঞ্জে ‘উদয়ের পথে’ নামে চরমপন্থি আত্মসমর্পণ কর্মসূচির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রায় ০৩ বছর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে র্যাব-১২ এর দায়িত্বাধীন ০৭টি জেলার পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট এলএম লাল পতাকার-২৯৪ জন, জনযুদ্ধের-০৮ জন এবং সর্বহারা গ্রুপের-২১ জনসহ সর্বমোট ৩২৩ জন চরমপন্থিকে প্রায় দুই শতাধিক অস্ত্রশস্ত্রসহ তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আজকের এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অপরাধ জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া এসব চরমপন্থিদের র্যাব ফোর্সেস এর পক্ষ হতে আর্থিক, মানবিক ও আইনী সহায়তা প্রদানসহ সমাজে স্বাভাবিক পেশায় পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। আপনাদের এই ফিরে আসার পথকে মসৃণ করতে বর্তমান সরকার সকল ধরণের সুযোগ সুবিধা প্রদান করবে।
র্যাব মহাপরিচালক আরো বলেন, ইতোপূর্বে র্যাব ‘উদয়ের পথে’ নামক পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে সর্বহারা পরিবারের মহিলা সদস্যদেরকে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করার কার্যক্রম চলমান রেখেছে। এছাড়াও বিভিন্ন চরমপন্থি দলের নেতা ও সদস্যদের আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে গরুর খামার, পোল্ট্রি ফার্ম, মাছ চাষ, চায়ের দোকান, ভ্যান-রিক্সা, সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে এবং তাদের পরিবারসমূহকে স্বাভাবিক পেশায় স্থানান্তরের পক্রিয়া চলমান রয়েছে। দেশের সাধারণ জনসাধারণের নিকট র্যাব ফোর্সেস যেমন আস্থা ও বিশ^াসের প্রতীক তেমনি সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের জন্য র্যাব ফোর্সেস মূর্তিমান আতংক। যারা আত্মসমর্পণ করবে না তাদেরকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি অপরাধ/সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আজকে যারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে র্যাবের দেওয়া এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলোর পথে ফিরে এসেছেন আমি তাদেরকে সাধুবাদ জানাই।
এসময় তিনি আরো বলেন, র্যাব ফোর্সের বিরুদ্ধ শুধু আন্তর্জাতিক সড়যন্ত্র নয়, দেশের ভিতরেও সড়যন্ত্র চলছে। র্যাব ফোর্সেস দেশী বা আন্তর্জাতিক সড়যন্ত্র তথা কারোর চোখ রাঙানিতে ভয় পায় না। দেশের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে র্যাব কোন প্রকার স্যাংশনকে পরোয়া করে না। র্যাব আইন মেনে কাজ করে, র্যাব মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘আপনারা জানেন ৮০-এর দশক থেকে এই এলাকার কয়েকটি জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় সর্বহারা ও চরমপন্থিরা ঘাঁটি তৈরি করে। পরে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে তারা আলোর পথে ফিরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী তখন সবার পুনর্বাসন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আজকেও আমাকে আসার আগে বলেছেন, যারা আত্মসমর্পণ করছেন তাদের আর্থিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘একসময় এই সাত জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আতঙ্কের নাম ছিল চরমপন্থি। প্রতিদিনই চাঁদাবাজি, গুম, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটতো এসব এলাকায়। চরমপন্থি আতঙ্কে দিন কাটতো সাধারণ মানুষের। এসব এলাকার চরমপন্থি নেতা ও সদস্যদের অন্ধকার থেকে আলোতে ফেরাতেই এমন আয়োজন।’
এর আগে র্যাব-১২ কোম্পানি কমান্ডার আবুল হাশেম সবুজ জানান, চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণ ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছে র্যাব। এছাড়া অপরাধের জীবন থেকে চরমপন্থি সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে র্যাব ২০২০ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। চরমপন্থি দলের নেতা ও সদস্যদের আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে গরুর খামার, পোলট্রি ফার্ম, মাছ চাষ, চায়ের দোকান, ভ্যান-রিকশা ও সেলাই মেশিন দেওয়া হয়।
র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেনের সভাপতিত্বে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমেদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান, পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাব-১২ অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মারুফ হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
© 2023 Dinkal24 All Rights Reserved.