স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আগামী ২১ মে সিরাজগঞ্জে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তিন শতাধিক চরমপন্থী।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভিন্ন একটি নাম ছিল রক্তাক্ত জনপথ। লুটতরাজ, জিম্মি, অপহরণ, খুন করে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল’কে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছিল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এমএল, জনযুদ্ধ, সর্বহারাসহ ১৪টির বেশী চরমপন্থি দল। এরা আন্ডার গ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি; যারা বন্দুক দিয়ে রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিল। সাধারণ মানুষ তাদের নিয়মিত চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই অঞ্চলের প্রতিটি পরিবার থেকে সামর্থ্যবান পুরুষকে যোগ দিতে হত চরমপন্থি দলে। 

অন্যথায় পুরো পরিবার নির্যাতনের শিকার হতো। রাত গভীর হলেই কলাপসেবল গেট আটকিয়ে আতংকে থাকতে হতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরকেই। তারা দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে নব্বই দশক হতে অদ্যাবধি প্রায় ২০ হাজার খুন হয়েছেন চরমপন্থিদের হাতে। এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যকে তাদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। 

এমনি অচলাবস্থায় সাধারণ মানুষকে স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে র‌্যাব কার্যক্রম শুরু করে। এক সময় বিভিন্ন চরমপন্থি গ্রুপের অভয়ারন্য হিসেবে পরিচিত উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আইন-শৃংখলা রক্ষায় শুরু থেকেই নজরদারি বৃদ্ধি এবং চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব। র‌্যাব সফল অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন চরমপন্থি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ অনেক সদস্যকেই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসে। চরমপন্থিদের সৃষ্ট ত্রাসের রাজত্ব র‌্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে ভেঙ্গে পড়ে। শীর্ষস্থানীয় চরমপন্থিসহ বিভিন্ন চরমপন্থি চলের সদস্যরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়; ফলে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফিরে আসে স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহের ক্রমাগত আভিযানিক প্রক্রিয়ায় চাপ সহ্য করতে না পেরে চরমপন্থি দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের সুযোগ খুঁজতে থাকে। অপরাধ জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া এসব চরমপন্থিদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করে র‌্যাব। চরমপন্থি নির্মূলে র‌্যাবের এই সৃষ্টিশীল ও সাহসী উদ্যোগের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেয়া চরমপন্থিরা স্বাভাবিক পেশায় তাদের জীবীকা নির্বাহ করবে; যাযাবর জীবন থেকে ফিরে পাবে সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন। পাশাপাশি, চরমপন্থিদের নির্যাতন ও লুটতরাজ ভয়ে সাধারণ মানুষকেও ভীত থাকতে হবে না। জনজীবনে ফিরে আসবে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ।

আগামী ২১ মে ২০২৩ তারিখ সিরাজগঞ্জে  র‌্যাব-১২ এর তত্তাবধানে হবে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলাসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন চরমপন্থি দলের সর্বমোট ৩২৩ জন সদস্য অস্ত্রসহ আত্মসমর্পনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে এসকল চরমপন্থিরা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র হামলা, হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল। তাদের এসকল অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রয়েছে এক/একাধিক মামলা। র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহের অভিযানের কারণে তারা দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে তারা স্বাভাবিক পেশায় ফিরতে পারছিল না। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তারা তাদের অপরাধ জীবন ছেড়ে স্বাভাবিকভাবে সমাজে বসবাস করতে পারবে।

অপরাধ দমনে র‌্যাবের কর্ম পরিকল্পনা বহুমাত্রিক। চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণ করিয়েই থেমে থাকেনি র‌্যাব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সক্রিয় অংশগ্রহণে অপরাধীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সর্বদা তৎপর রয়েছে র‌্যাব ফোর্সেস। অপরাধ দমনে র‌্যাব শুধু আভিযানিক প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। র‌্যাব ফোর্সেস এর গবেষণা ও প্রশিক্ষণের আলোকে সৃষ্টিশীল ও সময়োপযোগী নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন মানবিক ও সৃষ্টিশীল প্রকল্পের মাধ্যমে। এপ্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, কুষ্টিয়া, পাবনা, মেহেরপুর, রাজবাড়ী জেলাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বহারা ও চরমপন্থিদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাদেরকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করার জন্য বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজে স্বাভাবিক পেশায় পুনর্বাসিত করা হবে। টাঙ্গাইলে ৩০টি সর্বহারা পরিবারের মহিলা সদস্যদেরকে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করার জন্য ‘উদয়ের পথে’ নামক পাইলট প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। ভ‚মিহীনদের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য জমি বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন চরমপন্থি দলের নেতা ও সদস্যদের আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে গরুর খামার, পোল্ট্রি ফার্ম, মাছ চাষ, চায়ের দোকান, ভ্যান-রিক্সা, সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে চরমপন্থি সদস্য ও তাদের পরিবারসমূহকে স্বাভাবিক পেশায় স্থানান্তরের পক্রিয়া চলমান রয়েছে।

সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে র‌্যাব ফোর্সেস শুধু অভিযান নয় ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে কার্যকরী পন্থায় বিভিন্ন মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অপরাধীদের সে পথ হতে ফিরিয়ে আনার জন্য। জঙ্গি দমনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে কাজ করে যাচ্ছে র‌্যাব এবং জঙ্গি দমনে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি রোল মডেল। শুধুমাত্র গ্রেফতারের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নির্মূল নয় বরং আত্মসমর্পণ এর সুযোগ প্রদান করা এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট জঙ্গিদের সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা করছে র‌্যাব। ইতোমধ্যে “নবদিগন্তের পথে” শীর্ষক র‌্যাবের ডি-রেডিক্যালাইজেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রায় অর্ধ শতাধিক বিপথগামী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে সাধারণ জীবনে ফিরে এসেছে। আত্মসমর্পণ পরবর্তী তাদের পুনর্বাসনের লক্ষে র‌্যাব কর্তৃক বিভিন্ন ধরণের (ট্রাক্টর, গাভী, ফার্মেসী) সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, সরকারের পক্ষ হতেও আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। 

এছাড়া বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন সুন্দরবন ছিল বনদস্যু ও জলদস্যুদের অভয়ারণ্য। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশীয় ও বিদেশি শাসকরা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু কেউই পারেননি সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও দিক নির্দেশনা থেকেই র‌্যাব সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও একে একে সুন্দরবন, কক্সবাজার, মহেশখালী ও বাঁশখালী অঞ্চলের ৫০টি বাহিনীর ৪০৫ জন জলদস্যু ৬৫০টি অস্ত্র ৩২,২০৭ রাউন্ড গোলাবারুদসহ র‌্যাবের নিকট আত্মসমর্পণ করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যুদের নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি র‌্যাবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উৎসবে তাদের উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও জলদস্যু পরিবারকে সাবলম্বী করতে ১০২টি ঘর, ৯০টি মালামালসহ মুদি দোকান, ২২৮টি গবাদি পশু, ১২টি মাছ ধরার নৌকা ও জাল, ০৮টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা প্রদান করা হয়েছে। যার ফলে এখন শান্তির সু-বাতাস বইছে সুন্দরবন অঞ্চলে। এছাড়াও সুন্দরবন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যুদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে র‌্যাব।

এলিট ফোর্স র‌্যাব অপরাধ দমন এবং অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা ও ধরে রাখা কিংবা অপরাধ থেকে দুরে রাখার প্রয়াসে র‌্যাব ফোর্সেস ‘নবজাগরণ’- অপরাধকে না বলুন’ প্রকল্পের আওতায় সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়া ব্যক্তিবর্গ এবং বেকার ও স্বল্প আয়ের মানুষদের স্বাবলম্বী করার লক্ষে কক্সবাজারে ৩৬ জন প্রশিক্ষণার্থীকে সেলাই, ড্রাইভিং, টুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফি, রেস্টুরেন্ট সার্ভিস এবং সার্ফিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময় প্রশিক্ষণার্থীদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। নবজাগরণের মাধ্যমে সামাজিক, পারিবারিক ও মনস্তাত্তি¡ক অন্তরায় সৃষ্টি করে এলাকাভিত্তিক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেন সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ অপরাধে না জড়ানোর ব্যাপারে সচেতন থাকে।

শুধুমাত্র অপরাধীদের গ্রেফতার করে নয় অপরাধীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে র‌্যাব হয়ে উঠেছে জনগনের আস্থা ও ভালবাসার প্রতীক।

মন্তব্য করুন

Logo

© 2023 Dinkal24 All Rights Reserved.